রবিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৮

৪৯ ক্যাশ ইন ১ মিনিটে

বিকাশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের
প্রক্রিয়ার একটি হচ্ছে ‘ক্যাশ ইন’।
গ্রাহকরা নিজস্ব অ্যাকাউন্টে টাকা
জমা রাখেন।
রেজিস্টার খাতায় অন্তর্ভুক্তির
মাধ্যমে এ ধরনের একটি লেনদেন করতে
বিকাশ এজেন্টদের কমপক্ষে দুই মিনিট
লাগে। টাকা জমা হয়েছে কি না তা
মেসেজের মাধ্যমে নিশ্চিত হন গ্রাহক
ও এজেন্ট। তবে হুন্ডির টাকা লেনদেন
করার সময় এজেন্টরা এক মিনিটেই
৪৯টি পর্যন্ত ক্যাশ ইন করে ফেলেন—
এমন তথ্য রয়েছে। সন্দেহভাজন এই
লেনদেন হয় গভীর রাতে। দেশে-
বিদেশে থাকা হুন্ডি কারবারিচক্র
নগদ টাকায় সরাসরি লেনদেন করা
ঝুঁকির্পূণ মনে করায় এই পদ্ধতি বেছে
নিয়েছে। আর বিদেশে বিকাশের
সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্রবাসীদের
প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে চক্রটি।
প্রবাসীরা মনে করেন, বিদেশ থেকে
সরাসরি বিকাশের মাধ্যমে টাকা
আসছে। তবে বাস্তবে হুন্ডি চক্রটি
বিদেশে টাকা সংগ্রহ করে এবং
দেশে এক জায়গায় বসে প্রবাসীদের
স্বজনদের নম্বরে ক্যাশ ইন করে দিচ্ছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের
(সিআইডি) তদন্তে বিকাশ এজেন্টদের
মাধ্যমে হুন্ডি কারবারের এসব তথ্য
উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা কালের কণ্ঠকে
জানিয়েছেন, বিকাশের দুই হাজার ৮৮৭
সন্দেহভাজন এজেন্টের মধ্যে
সাতজনকে গ্রেপ্তারের পর বাকিদের
ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। হুন্ডিতে
জড়িত বলে শনাক্ত হওয়া পলাতক
একজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
পাশাপাশি অন্য মোবাইল
ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হুন্ডি হচ্ছে
কি না তাও যাচাই করছে সিআইডি।
গ্রেপ্তারকৃত সাতজনকে রিমান্ডে
নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে বিকাশের
মাধ্যমে হুন্ডি কারবারের বিস্তারিত
তথ্য পেয়েছে সিআইডির অর্গানাইজড
ক্রাইম ইউনিট (সংঘবদ্ধ অপরাধদল)।
এসব তথ্যের ভিত্তিতে এখন তদন্ত
চলছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস)
মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে
বলেন, ‘বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল
ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)
প্রতিবেদনে থাকা সন্দেহভাজন
বিকাশ এজেন্টদের ওপর আমরা
নজরদারি করছি। তাদের অ্যাকাউন্টে
বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে।
এখন শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে কারা,
কী পরিমাণ হুন্ডির টাকা লেনদেন
করেছেন। যাঁদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া
যাবে তাঁকেই আইনের আওতায় আনা
হবে। ’ তিনি আরো বলেন, হুন্ডি মানি
লন্ডারিং আইন আনুযায়ী বড় অপরাধ।
এতে দেশের বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে।
দেশে আরো মোবাইল ব্যাংকিং
আছে। তাদের এজেন্টরা এ ধরনের
অনৈতিক কাজে জড়িত কি না সেটাও
যাচাই করে দেখা হবে।
সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে অভিযান
চালিয়ে সিআইডি রাজশাহীর
গোদাগাড়ীর মাদারপুরের আব্দুল
মান্নান, পাবনার ডাঙ্গগুরার সংগীত
কুমার পাল, সাঁথিয়ার হাড়িয়া গ্রামের
জামিনুল হক, আমিনপুরের মোজাম্মেল
মোল্লা, সারাসিয়ার হোসেন আলী,
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার দিদারুল হক ও
আবু বকর সিদ্দিককে গ্রেপ্তার করে।
পরে আদালত তাদের বিভিন্ন মেয়াদে
রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রত্যেককে নিজ
নিজ এলাকার সিআইডি কর্মকর্তারা
জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। রিমান্ড
শেষে ছয়জনকে জেলহাজতে পাঠানো
হয়েছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত
রিমান্ডে ছিলেন রাজশাহীর আব্দুল
মান্নান। সিআইডি দুই হাজার ৮৮৭
জনের তালিকা থেকে শীর্ষ
লেনদেনকারী ২৫ জনকে নিয়ে প্রথম
দফায় তদন্ত শুরু করে। তাদের মধ্যে
আটজনকে শনাক্ত করে আটটি মামলা
দায়ের করা হয়। এদের মধ্যে পাবনার
মানোয়ার হোসেন মিন্টু এখনো
পলাতক।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন
কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন,
বিকাশে হুন্ডির লেনদেন হয় প্রতারণার
মাধ্যমে। মূলত প্রবাসীরা ভাবেন
বিকাশের মাধ্যমেই দেশে টাকা
যাচ্ছে। হুন্ডি সিন্ডিকেটের সদস্যরা
বিদেশ থেকে দেশের সদস্যদের কাছে
ইলেকট্রনিক বার্তা পাঠিয়ে প্রবাসীর
স্বজনের পারসোনাল বিকাশ নম্বর এবং
টাকার পরিমাণ জানিয়ে দেয়। এরপর
নির্দিষ্ট এজেন্টরা দৈনন্দিন কাজ
শেষ করে গভীর রাতে বসে একাধারে
ক্যাশ ইন করতে থাকে। সাধারণত একটি
ক্যাশ ইন করতে দুই মিনিট সময় লাগে।
তবে হুন্ডির এসব ক্যাশ ইন মুহূর্তেই হয়ে
যায়। এক মিনিটে ৪৯টি পর্যন্ত ক্যাশ
ইন করতে দেখেছেন বলে জানান ওই
কর্মকর্তা। তিনি আরো বলেন, ক্যাশ ইন
ছাড়া ‘সেন্ড মানি’ এবং ‘ক্যাশ আউট’
পদ্ধতিতেও বিকাশে লেনদেন হয়। তবে
হুন্ডির টাকা লেনদেন হচ্ছে শুধু ক্যাশ
ইনে। জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা
বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত এবং শনাক্ত
বিকাশ এজেন্টদের অ্যাকাউন্টে
কোটি কোটি টাকার লেনদেন আছে।
তবে ঠিক কত টাকা হুন্ডির লেনদেন
হয়েছে তা এখনো বের করা যায়নি।
ম্যানুয়ালি এবং প্রযুক্তির সহায়তায়
এটা বের করার চেষ্টা চলছে। তদন্তে
পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরো
অভিযান চলবে। ’
বেশি মধ্যপ্রাচ্য থেকে : সিআইডি সূত্র
জানায়, বিকাশের মাধ্যমে হুন্ডির
ঘটনা বেশি হয় মধ্যপ্রাচ্যে। সিঙ্গাপুর
ও মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশ
থেকেও হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে হুন্ডি
ব্যবসায়ীরা একটি কৌশল ব্যবহার করে।
বিদেশে বাঙালিদের পরিচালিত
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে
বিকাশসহ অন্যান্য মোবাইল
ব্যাংকিংয়ের সাইনবোর্ড টানানো
থাকে, যা দেখে প্রবাসীরা বিভ্রান্ত
হন। তাঁরা মনে করেন, বিদেশ থেকে
হয়তো বিকাশের মাধ্যমেই দেশে
টাকা পাঠানো যায়। সরল বিশ্বাসে
তাঁরা ফাঁদে পা দেন। এরপর বিকাশের
আড়ালে সংঘবদ্ধ চক্র মূলত হুন্ডির
মাধ্যমেই দেশে টাকা পাঠায়।
প্রবাসীর কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা
সংগ্রহ করে দেশে তাঁর স্বজনদের
বিকাশ নম্বর নেয়। এরপর দেশে থাকা
সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছে ওই
বিকাশ নম্বর এবং বৈদেশিক মুদ্রার
বিনিময়ে বাংলাদেশি টাকার
পরিমাণ জানিয়ে দেয়। এই
সিন্ডিকেটে সরাসারি জড়িত অনেক
বিকাশ এজেন্ট। তারা নম্বরগুলো
সংগ্রহ করে প্রবাসীর স্বজনদের
পারসোনাল বিকাশ অ্যাকাউন্টে
ক্যাশ ইন করে দেয়। এতে প্রবাসী ও
স্বজনরা কিছুই টেয় পান না। বাস্তবে
টাকা লেনদেন হচ্ছে হুন্ডিতে। এর ফলে
সরকার রেমিট্যান্স ও রাজস্ব
হারাচ্ছে।
বিকাশে সন্দেহজনক লেনদেন হচ্ছে
বলে শনাক্ত করে গত বছরের সেপ্টেম্বর
মাসে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল
ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)
একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল
সিআইডির কাছে। সেই প্রতিবেদনে দুই
হাজার ৮৮৭ জন এজেন্টের নাম আছে। এ
তালিকা ধরে তদন্তে নেমেছে
সংঘবদ্ধ অপরাধদল। বাংলাদেশে
কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোবাইল
ব্যাংকিং সেবা দিলেও এই খাতের
বড় অংশের লেনদেন ব্র্যাক ব্যাংকের
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে
হয়ে থাকে। বাংলাদেশে
প্রতিষ্ঠানটির এক লাখ ৮০ হাজার
এজেন্ট রয়েছে। সব ব্যাংকিং
প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট মোবাইল
ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট রয়েছে পাঁচ
লাখের বেশি।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: