বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭

সোফিয়া বনাম বাংলাদেশি রোবট রিবো

আমাদের বাংলাদেশে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের
একদল ছাত্রের তৈরি একটি রোবট আছে। তার নাম
রিবো (RIBO)। রোবটটি বানিয়েছে ওই
বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগসহ চারটি
বিভাগের ১১ জন তরুণ। এদের মধ্যে দলনেতা
হিসেবে কাজ করেছেন নওশাদ সজীব নামে এক
ছাত্র। তারা প্রায় দেড় মাস কাজ করে তৈরি করেন এই
রোবটটি। ফেসবুকে এমন একটি ভিডিও গত কয়েক
দিন ভাইরাল হয়েছে।
একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা গেল দুই বছর আগে ২০১৫
সালের ১১ ডিসেম্বর আয়োজিত ‘সায়েন্স ফিকশন
ফেস্টিভ্যাল ২০১৫’-এ প্রদর্শন করা হয় বাংলাদেশের
প্রথম হিউম্যানোয়েড রোবট—রিবো।
হিউম্যানোয়েড রোবট বলতে বোঝায় মানুষের
মতো দেখতে এবং মানুষের মতো আচরণ
করতে সক্ষম রোবটকে। এ ছাড়া এটি বাংলাদেশের
প্রথম সোশ্যাল রোবটও।
যা হোক, ভিডিওতে ‘ইনট্রোডিউসিং রিবো, দ্য ফার্স্ট
সোশ্যাল রোবট ইন বাংলাদেশ’ লেখা একটি
ব্যানারের সামনে আমাদের প্রিয়মুখ জাফর ইকবাল স্যার
আর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল
বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. শহীদুর রহমান যখন
রোবট রিবোর সঙ্গে কথা বলছেন তখন আর
সেই ভিডিও কনটেন্টের সত্যতা নিয়ে কোনো
সন্দেহ থাকে না। কেননা রোবটটি তৈরি করা
ছাত্রটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও জাফর স্যার
ও শহীদ ভাইকে খুব কাছে থেকে দেখেছি।
ব্যক্তিগতভাবে তারা আমার কাছের ও পরিচিতজন। তাঁরা
যেখানে আছেন, সেই ভিডিও কনটেন্টের সত্যতা
নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ থাকে না।
আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ভিডিওটির মধ্যে
দেখানো রোবট রিবোকে আমাদের জাফর স্যার
বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন আর সে উত্তর দিচ্ছে। স্যার
প্রশ্ন করছেন, তুমি ড্যান্স করতে পারো? সে
উত্তর দিচ্ছে হ্যাঁ। প্রশ্ন করছেন শহীদ ভাই, আর
সে উত্তর দিচ্ছে। একপর্যায়ে রোবটটির নির্মাতা
ছাত্রটি বলছে তুমি হ্যান্ডশেক করতে পার? সে হাত
এগিয়ে দিচ্ছে এবং হাত ঝাঁকাচ্ছে। ড. শহীদুর
রহমানের সঙ্গেই সে হ্যান্ডশেক করছে।
সবচেয়ে আনন্দের বিষয় রিবো বাংলায় কথা বলতে
পারে এবং বাংলা বোঝে। ড্যান্স শব্দটা ইংরেজি, জাফর
স্যার যখন প্রশ্ন করেন তুমি ড্যান্স করতে পার? তখন
সেই প্রশ্নের মধ্যে একটু চালাকি (হিউম্যান
ইন্টেলিজেন্স) ছিল! তিনি বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে
প্রশ্নটা করেছেন। আমার বিস্ময়, সোশ্যাল রোবট
রিবো সেটার অর্থ বুঝতে পেরেছে। তেমনি
হ্যান্ডশেক করতে পারো? প্রশ্নটাও বাংলা ইংরেজি
মিলিয়ে। সেটাও সে যথাযথভাবে বুঝতে
পেরেছে।
এই সবই কম্পিউটার প্রকৌশলের আর্টিফিশিয়াল
ইন্টেলিজেন্স আর স্পিচ রিকগনিশনের খেলা। সেই
সব নিয়ে কম্পিউটার প্রকৌশলীরা ভালো বলতে
পারবেন। আমি যেটা বলতে পারব সেটা হলো
রোবট সোফিয়া আর আমাদের বাংলাদেশি রোবট
রিবোর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য আছে বলে মনে
হলো না। ইমেজ ইঞ্জিনিয়ারিং করে সোফিয়ার
চেহারায় অড্রে হেপবার্নের যে আদল দেওয়া
হয়েছে সেটা আমাদের রিবোর চেহারাতেও
দেওয়া সম্ভব। তার চেহারাটাও ইমেজ ইঞ্জিনিয়ারিং
করে আমাদের বঙ্গবন্ধুর মতো সুন্দর করে
সাজানো সম্ভব। সোফিয়াকে জামদানির সালোয়ার
কামিজ পরানো গেলে আমাদের রিবোকেও
কুমিল্লার খাদি পরানো সম্ভব।
যত দূর জানি, সোফিয়াকে বাংলাদেশে নিয়ে
এসেছে গ্রে অ্যাডভারটাইজিং নামে একটি বিজ্ঞাপন
কোম্পানি। শোনা কথায় তার খরচ পড়েছে ১২
কোটি টাকা। সোফিয়ার পেছনের কথা যত দূর জানা
যায় তাতে আমার একটাই ধারণা হয়েছে, সেটা হলো
ডেভিড হ্যানসন নামে ব্যক্তিটি তার হংকং ভিত্তিক
কোম্পানি হ্যানসন রোবোটিকস নির্মিত সোশ্যাল
রোবটের সর্বশেষ ভার্সন সোফিয়াকে নিয়ে
দেশে বিদেশে মার্কেটিং করে বেড়াচ্ছেন। তিনি
যে কাজ করেছেন, তার মধ্যে নতুনত্ব বলতে
ইমেজ ইঞ্জিনিয়ারিং করে এর চেহারায় মানুষের আদল
আনা, আর তার সঙ্গে সঙ্গে সেটা যদি অড্রে
হেপবার্নের মতো হয় তবে সেটা বিভিন্ন
দেশের মানুষের মনকে বেশি নাড়া দেবে, আরও
গ্রহণযোগ্যতা পাবে মিডিয়ায়। সেটাই হয়েছে।
বিভিন্ন দেশের মিডিয়ার সামনে তাকে বিভিন্ন রকমের
কাপড় পরিয়ে হাজির করায় তার কোম্পানির
রোবোটিকসের নাম এখন পৃথিবী জোড়া। গুগলে
একটু খোঁজ করলেই দেখা যাবে এই সংক্রান্ত কাজ,
মানে রোবোটিকসের কাজ পৃথিবীতে এখন
কোন পর্যায়ে আছে। ৩০ বছর গবেষণা করে
জাপানের হোন্ডা কোম্পানি আসিমো নামে একটি
রোবট বাজারে বিক্রিও করছে যার দাম ২৫ লাখ ডলার।
সোফিয়ার চেয়ে হোন্ডা কোম্পানি নির্মিত
রোবট আসিমো (ASIMO) কম রংবাজি করতে জানে
না। কাজেই ডেভিড হ্যানসন এবং তার কোম্পানি হ্যানসন
রোবোটিকসের সোফিয়া আমাদের সামনে নতুন
কিছু নয়।
কৌতূহল মেটাতে আমাদের দেশীয় সোশ্যাল
রোবট রিবোকে নিয়ে ইন্টারনেটে আরও একটু
ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা গেল সেখানে আমাদের সরকারি
সহায়তা রয়েছে। যদিও সেটা আরও বাড়ানো
প্রয়োজন এবং সে সম্পর্কে পরে আসছি।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব রোবোসাস্ট
জানাচ্ছে তাদের রিবো প্রজেক্টে সরকারের
সহায়তা রয়েছে। গত ৬ ডিসেম্বরে দেওয়া একটা
ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যাচ্ছে, সরকার জুন
মাসে সেখানে ১০ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে।
রোবোসাস্ট-এর গত মে মাসের একটা ফেসবুক
পোস্ট থেকে জানা যায় তারা শাহজালাল
বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল
বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আয়োজিত রোবোটিকস
প্রতিযোগিতা ‘রোবোওয়ার্স ২০১৭’-এ অংশ
নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তারা চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমাদের
স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করেছে। উল্লেখ করা
যেতে পারে দেশের ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮টি
দল এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল।
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য সবাইকে এটা জানানো,
আমাদের বাংলাদেশেও একটি রোবট আন্দোলন
চলছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বুয়েটে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি রোবোটিকস ল্যাব,
যেখানে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। তবে এটাও সত্যি,
আজকে আমাদের সোফিয়াকে ১২ কোটি টাকা
খরচ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য
অনেকেই কানাঘুষা করছেন। আসলেই কি তাই? এটা
সত্যি হলে আমরা এর সমালোচনা করছি। সোফিয়াকে
আনার জন্য বিপুল পরিমাণ পয়সা না খরচ করে
বাংলাদেশের রিবো এবং এর পেছনের ক্লাবসহ
রোবট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য
সংগঠনগুলোকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক ও বিশেষজ্ঞ
সহায়তা দেওয়া জরুরি।
শুধু সরকারের বিরোধিতা করার জন্য অনেকে
মুখিয়ে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এই সব
কর্মযজ্ঞে যে উৎসাহ উদ্দীপনা আর প্রণোদনা
দিয়ে যাচ্ছে তা অভূতপূর্ব। সরকার সে জন্যে
ধন্যবাদ পেতেই পারে। যারা সমালোচনা আর
বিরোধিতা করছেন তাদের এটাও বুঝতে হবে যে,
সোফিয়াকে দেখে আমাদের ছাত্রছাত্রী আর
গবেষকদের উৎসাহ আরও বাড়বে। সারা বিশ্বের
রোবট নিয়ে গবেষণার সাপেক্ষে আমাদের
অবস্থান অনুধাবন করতে পারবে বলেই আমাদের
বিশ্বাস। আর এ কথাও ঠিক যে, দেশের মেধাকে
বিকশিত হওয়ার জন্য তাদের আর্থিক প্রণোদনা,
সচ্ছলতা আর অনুপ্রেরণা দেওয়াটা বিশেষ জরুরি।
তবেই আমাদের তারুণ্য জয়ী হবে, বিশ্বের
মানচিত্রে তুলে ধরবে আমাদের প্রিয় এক টুকরো
বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: